ইউরিক এসিড কমানোর ঘরোয়া উপায়

ইউরিক এসিড কমানোর ঘরোয়া উপায়


ইউরিক অ্যাসিড কি?

ইউরিক অ্যাসিড একটি রাসায়নিক পদার্থ যা খাবার হজম হওয়ার সময় শরীরে তৈরি হয়। ইউরিক অ্যাসিড পিউরিন নামক এক ধরনের অ্যামিনো অ্যাসিড নিয়ে গঠিত, যা নির্দিষ্ট কিছু খাবারে পাওয়া যায়। ইউরিক অ্যাসিড রক্তের সাথে মিশে এবং কিডনি দ্বারা ফিল্টার করা হয় এবং প্রস্রাবে নির্গত হয়। কিন্তু অনেক সময় শরীর এত বেশি ইউরিক অ্যাসিড তৈরি করে যে তা ঠিকভাবে ফিল্টার করা যায় না। রোগের পারিবারিক ইতিহাস, ব্যায়ামের অভাব এবং প্রচুর পরিমাণে মাংস খাওয়া শরীরে অত্যধিক ইউরিক অ্যাসিড তৈরি করতে পারে।

ইউরিক অ্যাসিড বাড়লে কি হয়?

বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে গেলে তা জয়েন্ট ও মূত্রনালিতে জমে। এবং দীর্ঘ সময়ের জন্য একটি স্ফটিক মত হয়ে যান। অন্যদিকে, এটি পিত্তথলি বা মূত্রথলির পাথরের অন্যতম কারণও বটে।

গবেষকদের মতে, রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের উচ্চ মাত্রা একজন ব্যক্তির জীবন 11 বছর কমিয়ে দিতে পারে। মানুষের রক্তে ইউরিক এসিড বেড়ে গেলে তা শরীরে বিপজ্জনক অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে। এর পরিমাণ বেড়ে গেলে আর্থ্রাইটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি ফেইলিওরের মতো সমস্যা হতে পারে।

অলস জীবনযাপন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, খাবারে প্রক্রিয়াজাত খাবারের আধিক্য রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে। রক্তে ইউরিক এসিডের উচ্চ মাত্রার এই সমস্যাকে চিকিৎসার ভাষায় বলা হয় 'হাইপারইউরিসেমিয়া'। আর ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে গেলে জয়েন্টে ব্যথা অনিবার্য।

ইউরিক অ্যাসিড প্রধানত হাড় এবং কিডনি প্রভাবিত করে। খাওয়া-দাওয়ায় একটু বাছবিচার করে এ সমস্যা এড়ানো সম্ভব। কিন্তু ইউরিক অ্যাসিডের লক্ষণ সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা নেই। কিভাবে বুঝবেন আপনি এই রোগে আক্রান্ত কিনা?

শরীরে ইউরিক এসিড বেড়ে গেলে ঘন ঘন প্রস্রাব হয়। কারণ কিডনি শরীর থেকে অতিরিক্ত ইউরিক অ্যাসিড বের করে দিতে চায়। তবে অতিরিক্ত প্রস্রাবের পাশাপাশি শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে গেলে মূত্রনালীতেও রক্তক্ষরণ হতে পারে। এছাড়াও, ইউটিআই বা মূত্রনালীর সংক্রমণ হতে পারে।

ইউরিক অ্যাসিডের সমস্যা বেড়ে গেলে অনেকেরই প্রস্রাবের সময় জ্বালাপোড়া অনুভব করে। এই জ্বালা কখনও কখনও এত বেশি হয় যে রুগী প্রস্রাব করতে ভয় পায়। এতে কিডনিতে পাথরও হতে পারে। এছাড়া এই রোগের কারণে প্রস্রাবের তীব্র গন্ধও হতে পারে। তাই আপনারও যদি এমন হয় তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে গেলে তা পিঠের নিচে, তলপেটে বা কুঁচকিতে ব্যথা হতে পারে। তাই এমন লক্ষণ দেখা গেলেও সতর্ক থাকুন।

পিরিয়ডের ব্যথা কমানোর ঘরোয়া উপায় ও চিকিৎসা

অনেকেই পায়ে ব্যথা নিয়ে সকালে ঘুম থেকে ওঠেন বা আঙ্গুল বাঁকাতে পারেন না এবং অনেকের জয়েন্ট ফুলে যায়। বিশেষজ্ঞরা একে ইউরিক অ্যাসিডের লক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আজকাল ইউরিক অ্যাসিডের সমস্যা যেমন রক্তচাপ, ডায়াবেটিসের মতো লাইফস্টাইল ডিজিজের আওতায় পড়ে। রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে গেলে খাবার থেকে অনেক কিছুই বাদ দেওয়া হয়। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকা থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রোটিন জাতীয় খাবার, এমনকি শাকসবজি বা মসুর ডালও বাদ দেওয়া হয়।

চিকিৎসকের মতে, প্রতিদিনের তালিকা থেকে শুধু কয়েকটি খাবার বাদ দিলেই ইউরিক অ্যাসিড কমবে না। তাদের মতে, ইউরিক অ্যাসিড হল প্রস্রাবে উপস্থিত বিভিন্ন যৌগগুলির মধ্যে একটি। আমাদের শরীরে তা থাকবে। কিন্তু কতটা থাকবে তা নির্ভর করে প্রোটিন গ্রহণ এবং বিপাকীয় হারের ওপর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিছু ঘরোয়া উপায়ে ইউরিক অ্যাসিডের সমস্যা থেকে দূরে থাকা সম্ভব। তাই দ্রুত সেই পদ্ধতি জেনে নিন।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউরিক অ্যাসিডের বিপদ এড়াতে ৯ ধরনের খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। পালং শাক, মাশরুম, লাল মাংস, চিংড়ি, টমেটো, মুগ ডাল, মসুর ডাল, সয়াবিন এবং কফি এড়িয়ে চলুন।

গবেষকদের মতে, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেলে রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা স্বাভাবিক করা যায়। একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্য এবং ফিটনেস এক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। রান্নায় তেল ও মশলা কমিয়ে দিন। এছাড়াও বড় মাছ, লাল মাংস, বেকন, লিভার, চিনি এড়িয়ে চলুন।

আপনার খাদ্যতালিকায় ভিটামিন সি অন্তর্ভুক্ত করুন। লেবু বা ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল নিয়মিত খান। ভিটামিন সি ইউরিক অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণে দারুণ কাজ করে। প্রোটিন হজমের পরে, শরীর অ্যামোনিয়া তৈরি করে। এটি ইউরিক অ্যাসিডও তৈরি করে। তাই অতিরিক্ত প্রোটিন খাওয়া বন্ধ করুন।

চর্বিহীন মাংস খান। যেমন: ছোট মুরগি। কুসুম ছাড়া মাছ, ডিম পরিমাণ মতো খাওয়া যেতে পারে। ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার বেশি করে খান। যেমন: শাকসবজি, ভেষজ ইত্যাদি। এই ফাইবারগুলি স্ফটিকের সাথে যুক্ত হয়ে যায় এবং মলের সাথে শরীর থেকে নির্গত হয়। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট জাতীয় খাবার বেশি করে খেতে হবে। যেমন: লেবু-চা, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল (পেয়ারা, আমলকি, কমলা, মাল্টা), গ্রিন-টি ইত্যাদি খেতে পারেন। জেনে নিন কোন খাবারগুলো রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা কমায়-

লেবুর শরবতঃ

লেবুর পানিতে ভালো পরিমাণে ভিটামিন সি থাকে। এছাড়া এই পানিতে রয়েছে সাইট্রিক অ্যাসিড। এই সাইট্রিক অ্যাসিড এবং ভিটামিন সি আপনার শরীর থেকে অতিরিক্ত ইউরিক অ্যাসিড বের করে দিতে সক্ষম। এক্ষেত্রে লেবু পানি পান করতে পারেন। এক গ্লাস পানিতে একটি লেবু মিশিয়ে পান করুন। এভাবে দিনে দুবার লেবু পানি পান করুন। হাতে কলমে ফলাফল পাবেন।

ডিমঃ

আপনি ডিমের চেয়ে ভাল প্রোটিন পাবেন না। এক্ষেত্রে পিউরিন কম থাকায় ইউরিক অ্যাসিড বাড়ে না। একটি সেদ্ধ ডিমে আছে ভিটামিন-এ, ফোলেট, ভিটামিন-বি-5, ভিটামিন-বি-12, ভিটামিন-বি-2, ফসফরাস, সেলেনিয়াম, ভিটামিন-ডি, ভিটামিন-ই, ভিটামিন-কে, ভিটামিন-বি-6, ক্যালসিয়াম, জিঙ্ক, একটি ওমেগা -3 ফ্যাট।

পেঁয়াজঃ

পেঁয়াজ আপনার শরীর থেকে অতিরিক্ত ইউরিক অ্যাসিডও বের করে দিতে পারে। এক্ষেত্রে পেঁয়াজ কাঁচা খাওয়াই ভালো। তাই সালাদ হিসেবে পেঁয়াজ খেতে পারেন। এভাবে কাঁচা পেঁয়াজ খেলে শরীরে মেটাবলিজমের সমস্যা দূর হয়। আপনি চাইলে পেঁয়াজের রস নিয়ে খালি পেটে খান।

আপেল সিডার ভিনেগারঃ

আপেল সাইডার ভিনেগারে ভালো পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। তাই এই ভিনেগার শরীরের পিএইচ ব্যালেন্স রক্ষা করার পাশাপাশি ইউরিক অ্যাসিড কমাতে পারে। এক্ষেত্রে ২-৩ চামচ আপেল সাইডার ভিনেগার নিয়ে খান। তারপর আপনি চাইলে ধীরে ধীরে খাবারের পরিমাণ বাড়াতে পারেন।

গ্যাসের ব্যথা কেন হয়? গ্যাসের ব্যথা কমানোর ঔষধ ও মূল্য  

ব্রকলিঃ

যারা গাউটে ভুগছেন তাদের জন্য ব্রকলিকে সেরা বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ব্রকলিতে রয়েছে ভিটামিন সি। চিকিৎসকদের মতে, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খেলে সহজেই গাউট নিরাময় হয়। এছাড়া ভিটামিন সি শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা কমাতেও সাহায্য করে। 

শসাঃ

বিশেষজ্ঞদের মতে, শসায় প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে যা মেটাবলিজম ঠিক রাখতে সাহায্য করে। শসা শরীর থেকে ইউরিক অ্যাসিড দূর করতে সাহায্য করে। তাই আপনিও যদি ইউরিক অ্যাসিডের সমস্যায় ভুগে থাকেন তাহলে প্রতিদিন এটি খান।

মটরশুটিঃ

মটরশুঁটি আমাদের সকলের পছন্দের একটি সবজি, এই সবজিটি প্রোটিনের একটি বড় উৎস। এটি শুধুমাত্র ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে না বরং গাঁট এর ব্যথা ও কমাতে সাহায্য করে। 

করলাঃ

ইউরিক অ্যাসিডের সমস্যায় করলা সবচেয়ে কার্যকর। গবেষণায় দেখা গেছে করলার রস রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা কমায়। করলাতে রয়েছে আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, ভিটামিন সি যা শরীরের জন্য প্রয়োজনীয়। ক্যালসিয়াম, বিটা-ক্যারোটিন, পটাসিয়ামের গুরুত্বপূর্ণ উৎস।

আপেলঃ

আপেল ইউরিক অ্যাসিডের সেরা প্রতিকার। সাম্প্রতিক এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। আপেল ফাইবার সমৃদ্ধ। এই ফাইবার রক্ত থেকে ইউরিক অ্যাসিড শোষণ করে। এছাড়াও ম্যালিক অ্যাসিড রয়েছে। যা ভিটামিন সি এর খুব ভালো উৎস।তাই আপনার প্রতিদিনের খাবারে আপেল রাখতে ভুলবেন না।

সাইট্রাস ফলঃ

ইউরিক অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণে প্রতিদিন লেবু, আঙুর, আনারস, মুসাম্বি জাতীয় ফল খান। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে। এটি রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা কমায়। এটি বাতের ব্যথা কমাতেও সাহায্য করে। কিন্তু যদি রাতে ক্যালসিয়াম ওষুধ খান তাহলে সকালে লেবু না খাওয়াই ভালো। এতে ওষুধের কার্যকারিতা কমে যাবে। এছাড়াও, লেবু দিয়ে গরম জল খাবেন না।

ভিটামিন ইঃ

আপনি যদি ইউরিক অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ করতে চান তবে আপনার প্রতিদিনের তালিকায় ভিটামিন ই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অ্যাভোকাডো ভিটামিন ই সমৃদ্ধ একটি ফল। তবে এটি সবসময় পাওয়া যায় না। পরিবর্তে সূর্যমুখী বীজ, বাদাম আপনি সবসময় খেতে পারেন। তবে এটি ব্যথা এবং প্রদাহ কমায়। পা ফোলা সমস্যায়ও ভালো কাজ করে।

কলাঃ

ইউরিক অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণেও কলা ভূমিকা রাখে। কলাতে পটাশিয়াম থাকে। কলায় পিউরিনের পরিমাণও কম থাকে। আর তাই প্রতিদিন একটি করে কলা খেলেও ইউরিক অ্যাসিড সীমার মধ্যে থেকে যায়।

প্রতিদিন আড়াই থেকে তিন লিটার পানি পান করুন। ইউরিক অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে ব্যায়াম করতে হবে। এই ক্ষেত্রে, প্রতিদিন অন্তত 45 মিনিট ব্যায়াম করা আবশ্যক। তবেই আপনি ভালো থাকতে পারবেন। তাই চিন্তার কোনো কারণ নেই। খাওয়ার পাশাপাশি, আপনি যদি একটি ভাল বিপাক বজায় রাখতে চান তবে আপনাকে ঘুমাতে হবে। ঘুম 7 ঘন্টার বেশি হওয়া উচিত। তবেই আপনি ভালো থাকতে পারবেন। 

এছাড়া ও ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ থাকা সম্ভব। সেক্ষেত্রে একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চিকিৎসা নিতে হবে। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম