পাইলস দূর করার কার্যকর ঘরোয়া উপায়

 

পাইলস দূর করার কার্যকর ঘরোয়া উপায়

মানুষের পায়ুপথে শিরাযুক্ত অংশ হচ্ছে পাইলস যা হেমোরয়েড নামেও পরিচিত। প্রতিটি মানুষেরই পায়ুপথের এই অংশটি বিদ্যমান। তাই এটি কোনো রোগ কিংবা রোগের লক্ষ্যণ নয়। হাত ব্যথা, মাথা ব্যথার মতো পায়ুপথেরও কিছু সাময়িক সমস্যা হয়ে থাকে কিছু কিছু মানুষের নিজের করা ভুলের কারণে। পাইলস হচ্ছে পায়ুপথের সেরকম একটা সাময়িক সমস্যা। পাইলস হওয়ার কারণ কী? পাইলস এর কার্যকর ঘরোয়া চিকিৎসা সম্পর্কে এখানে সঠিকভাবে জানতে পারবেন। 

পাইলস হওয়ার কারণ কী? 

পায়ুপথের সমস্যা গুলোর মধ্যে পাইলস ও এনাল ফিসারের কথা অনেক মানুষই জানে। আবার অনেকে অর্শ্ব-গেঁজা নামেও চিনে। কিন্তু পাইলস আর এনাল ফিসার অথবা অর্শ্ব-গেঁজা এক না। পাইলস একটি আলাদা অর্শ্ব বা পায়ুপথের সমস্যা, কিন্তু এটা অর্শ্ব - গেঁজার থেকে আলাদা। 

পাইলস হচ্ছে পায়ুপথে অবস্থিত শিরা গুলো কোনো কারণে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ফুলে ফেঁপে যাওয়া এবং অবস্থা বিশেষে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়া। অর্থাৎ শিরা গুলোর ফোলা অবস্থা হলো পাইলস। এর জন্য মানুষের করা কিছু ভুল কাজই দায়ী। 

যেসব কারণে পাইলস এর সমস্যা হয়ে থাকে -

১. কোষ্ঠকাঠিন্য 

এটা সবচেয়ে বড় কারণ পাইলস হওয়ার পেছনে। কারণ কোষ্ঠকাঠিন্য হলে মলত্যাগের পরিমাণ কমে যায়, মল শুকনা হয়ে যাওয়ায় পায়ুপথে জোরে চাপ দিয়ে মলত্যাগ করতে হয়। জোরে চাপ দিতে গিয়েই পাইলস গুলো আঘাতপ্রাপ্ত হয়। ফলে সেগুলো ফুলে যায়।

২. পাতলা পায়খানা বা ডায়রিয়া 

কোষ্ঠকাঠিন্য হলে যেমন পায়ুপথের উপর ব্যাপক চাপ পড়ে, ডায়রিয়া হলেও তেমনই চাপ পড়ে। কারণ বারবার মলত্যাগ করতে হয়। বারবার মলত্যাগের ফলে পায়ুপথ ব্যস্ত হয়ে যায় অর্থাৎ বেশি চাপ পড়ে। অতিরিক্ত চাপ পড়ায় পায়ুর চারপাশে অবস্থিত চিকন শিরা গুলো আহত হয় ফলে পাইলস সৃষ্টি হয়।

৩. আলগাভাবে বসা

এটা হচ্ছে কোনো কিছুতে নিতম্ব না লাগিয়ে বসা।  মানে আপনি চেয়ারেও বসলেন না, বিছানায়ও না, সোফাতেও না। এককথায় কোনো কিছুতেই আপনার পশ্চাৎদেশ স্পর্শ করিয়ে না বসা। শুধু দুই পায়ের উপর ভর দিয়ে টয়লেটে বসার মতো করে দীর্ঘসময় বসে থাকার ফলে পায়ুপথে চাপ পড়ে। যা পাইলস সৃষ্টি করতে পারে। 

৪. গর্ভবতী নারীদের সন্তান প্রসব

সন্তান প্রসবের জন্য জরায়ু ও পায়ুপথ সংযুক্ত কারী শিরা-উপশিরায় প্রেসার লাগার কারণেও সন্তান প্রসবের পর সেই নারীর পাইলস এর দেখা দিতে পারে। 

৫. পায়ুপথে সেক্স করা

এনাল সেক্স তথা পায়ুপথে লিঙ্গ বা সেরকম কিছু ঢুকিয়ে যৌনতা করার ফলে সেই শিরা গুলোতে অনবরত ঘসা লাগায় তা ফুলে গিয়ে পাইলস সৃষ্টি করতে পারে। 

৬. ভারী বস্তু উঠানো

এটা নিশ্চয় জানেন যে, কোনো ভারী বস্তু কে মাটি থেকে উপরে তোলার জন্য শরীরের নিচের অংশে বেশি বল প্রয়োগ করতে হয়। দুই পায়ে বল প্রয়োগ করে বস্তুটি উপরে তোলার সময় পায়ুপথেও চাপ পড়ে যায়। অনবরত অনেকক্ষণ ধরে সেই কাজ করতে থাকলে পায়ুপথ আহত হয়ে পাইলস হতে পারে। 

৭. স্থুলতা 

বিএমআই লেভেলের বেশি যাদের ওজন হয় তাদের মধ্যে পাইলস এর সম্ভাবণা অনেকাংশে দেখা যায়। 

৮. অলসতা 

শারীরিক পরিশ্রমের ঘাটতি থাকলে দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গুলো দূর্বল হয়ে যায়। সাথে বিভিন্ন শিরা-উপশিরা গুলোও।

৯. বয়সজনিত কারণ 

গবেষণায় দেখা গেছে ষাটের অধিক বয়সী মানুষের মাঝে পাইলস হওয়ার প্রবণতা বেশি।

১০. খাবার

খাবার তালিকায় ফাইবার যুক্ত খাবার না থাকা ও পর্যাপ্ত তরল খাবার না খাওয়া অন্ত্র ও পায়ুপথ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করে। 

অন্ত্র ও পায়ুপথের পেশি, শিরা-উপশিরায় যখন অস্বাভাবিকতা ও অধিক চাপের সৃষ্টি হয় তখন তা পাইলস এরও সৃষ্টি করে।

কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার সহজ উপায় 

পাইলস এর কার্যকর ঘরোয়া চিকিৎসা 

পাইলস হওয়ার কারণগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করলেই ঘরোয়া চিকিৎসার মাধ্যমে পাইলস নিরাময় করা সম্ভব। এমনকি ডাক্তারের কাছে না গিয়েও দুই সপ্তাহের মধ্যে পাইলস দূর করা যায়। তার জন্য উপরে উল্লেখিত কারণগুলোর কথা ভাবতে হবে এবং সেগুলো না করার চেষ্টা করতে হবে।

পাইলস এর কার্যকর ঘরোয়া চিকিৎসায় যা যা করবেন -

১. কোষ্ঠকাঠিন্য দূরে রাখুন

কোষ্ঠকাঠিন্য যেন না হয় সেদিকে সতর্ক থাকুন। বেশি বেশি পান পান করে ও ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খেয়ে কোষ্ঠকাঠিন্য বিদায় করুন। 

২. মলত্যাগে বেশি বল প্রয়োগ না করা

টয়লেট করতে বসে জোরে বল প্রয়োগ করে পায়ুপথকে চাপে ফেলবেন না। স্বাভাবিক বল দিয়ে মলত্যাগ করুন। পর্যাপ্ত তরলের অভাবে মল শক্ত হওয়ায় মলত্যাগ করতে চাপ দিতে হয়। তাই প্রতিদিন বেশি বেশি পানি পান করে মল নরম রাখুন।

৩. পায়ুপথ নরম রাখা 

পানিশূন্যতার কারণে পায়ুপথ ও তৎসংলগ্ন অংশগুলোও শুকিয়ে যেতে পারে। তাই বেশি করে পানি পানের পাশাপাশি মাঝেমধ্যে হালকা গরম পানিতে পায়ু ডুবিয়ে বসে থাকুন গোসলের সময়। তাতে পায়ুপথ পানিশূন্যতা মুক্ত থাকবে ও নরম থাকবে। ফলে মলত্যাগে কষ্ট পেতে হবে না। 

৪. আলগাভাবে না বসা

দীর্ঘক্ষণ একই অবস্থায় আলগাভাবে বসে থাকবেন না। কোনো সমতল কিছুর উপর পশ্চাৎদেশ ভর দিয়ে বসুন।

৫. পায়ুপথ দিয়ে সঙ্গম না করা

যৌনতায় পায়ুপথ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। অর্থাৎ এনাল সেক্স করা যাবে না এবং কোনো কিছু ঢুকানো যাবে না। 

৬. ভারী বস্তু উত্তোলন না করা

অতিরিক্ত বল প্রয়োগে কোনো কিছু উপরে উঠানোর প্রয়োজন হলে সহজ ও নিরাপদ উপায় অবলম্বন করুন। একাই অতিরিক্ত ওজনের কোনো বস্তু উত্তোলনের কাজ বেশিক্ষণ করবেন না। তোলার ফাঁকে ফাঁকে বিরতি নিন।

৭. ফাইবার সমৃদ্ধ ও তরল খাবার খাওয়া 

গবেষণা থেকে জানা গেছে যারা নিয়মিত শাকসবজি, ফলমূলের মতো ফাইবার যুক্ত খাবার খেয়েছে তাদের মধ্যে পাইলস এর কোনো সমস্যা দেখা যায়নি। শাকসবজি অন্ত্র ভালো রাখে বিধায় কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয় এবং হজমশক্তি ভালো থাকে।

তরল খাবার পানিশূন্যতা ও কোষ্ঠকাঠিন্যতা প্রতিরোধ করে। প্রতিদিন ৮-১২ গ্লাস পানি অবশ্যই খেতে হবে। পাশাপাশি সম্ভব হলে দুধ, দই, স্যুপ, জুসও খাওয়া যাবে।

৮. ওজন কমিয়ে ফিট থাকা ও পরিশ্রম করা

শারীরিক পরিশ্রম না করায় দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গুলো স্বাভাবিকভাবে কাজ করার শক্তি পায় না। পরিশ্রম না করলে ওজন বেড়ে গিয়ে স্থুলতার সৃষ্টি করে যা বড় একটি স্বাস্থ্য সমস্যা। ওজন কমানোর জন্য শারীরিক পরিশ্রম অবশ্যই করতে হবে। নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করলে একইসাথে একাধিক সুবিধা পাওয়া যায়। যেমন- ওজন কমানো সম্ভব হয় এবং অন্ত্র ভালো থাকে। অন্ত্র ভালো থাকলে পেটের বিভিন্ন রোগও দূরে থাকে।

পাইলস দুর করতে কার্যকর ঘরোয়া এই উপায়গুলো মেনে চললে সহজেই বিনা চিকিৎসায় পাইলস দূর করা যাবে। 

শেষকথা, 

পাইলস কোনো মারাত্মক রোগ নয়। নিজেদের কিছু ভুল কাজের জন্যই এই জটিলতার সৃষ্টি হয়। পাইলস এর কার্যকর ঘরোয়া চিকিৎসা বিষয়ক এই আলোচনায় যে উপায়গুলো বলা হয়েছে সেগুলো অবলম্বন করলেই অল্প কয়েকদিনের মধ্যে অস্বস্তিকর ও বিব্রতকর এই অর্শ্ব রোগ প্রতিকার করা যাবে। 

কিন্তু যদি ঠিকমতো ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তাহলে সমস্যা আরও জটিল হয়ে রক্তপাত হওয়া, অতিরিক্ত ফুলে যাওয়া, একবার ভালো হয়ে কিছুদিন পর আবার দেখা দেওয়ার মতো অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। তাই দেরি না করে ঘরোয়া চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করে পাইলস প্রতিকার করার ব্যবস্থা নিন। অবস্থা বেশি জটিল হলে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম