বিয়ের প্রস্তুতি হিসাবে মেয়েদের জরুরী শারীরিক পরীক্ষা ও করনীয়

 

বিয়ের প্রস্তুতি হিসাবে মেয়েদের জরুরী শারীরিক পরীক্ষা ও করনীয়

বিয়ের প্রস্তুতি কিভাবে নেয়া উচিৎ?

বিয়ের আগে সব মেয়েরাই নিজের যত্ন নিতে শুরু করে। যাতে বিয়ের সময়টায় নিজেকে একটু বেশিই সুন্দর লাগে। পার্লারে যাওয়া,টুকটাক স্কিন কেয়ার, বডি কেয়ার শুরু করা এই সময়ে খুবই কমন এবং করাও উচিৎ।  তবে বাহ্যিক সৌন্দর্যের যত্ন নিতে নিতে আমরা ভুলে যাই আমাদের ভেতরের যত্ন নেয়ার কথা। কিন্তু বিয়ের আগে কিন্তু এই জিনিসটাই সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারন আপনি ভিতর থেকে যতবেশি ফিট হবেন আপনার কনফিডেন্স বাড়বে। এবং এই কনফিডেন্স এর গ্লো আপনি কোন স্কিনকেয়ার করে পাবেন না। 

১)প্রথমত বিয়ের আগে কিছু মেডিকেল টেস্ট করে নেয়া জরুরি। টেস্ট গুলো হচ্ছে - CBC,ESR,HOMA IR, TSH, LH, FSH, Progesterone, Lipid Profile, Serum Electrolyte , USG of whole abdomen.  

যদি এই টেস্ট গুলো তে কোন সমস্যা থাকে, যেমন আপনার শরীরে হিমোগ্লোবিন কম, ব্লাডে হালকা ইনফেকশন আছে, শরীরে কোন হরমোনাল ইমব্যালেন্স আছে, বা আল্ট্রাসাউন্ড এ পিসিওএস ধরা পরেছে। তাহলে সেই স্পেসিফিক সমস্যার জন্য ডাক্তার দেখিয়ে এবং একজন প্রফেশনাল নিউট্রিশনিষ্ট এর পরামর্শ নিয়ে সমস্যাগুলো সমাধান করার জন্য পদক্ষেপ নেয়া উচিত। 

২) অনেকেই আছেন যাদের কি কি সমস্যা আছেন তারা সেটা জানেন। কিন্তু নিজের অলসতা বা নিজের প্রতি উদাসীনতা থেকে সমস্যা গুলোর সল্যুশন করতে চাননা। এটা উচিৎ নয়। নিজের সব থেকে বড় দিন টার জন্য সুন্দর ভাবে প্রিপারেশন নিতে একজন নিউট্রিশনিষ্ট এর পরামর্শ নিয়ে লাইফস্টাইল পরিবর্তন করুন। 

৩) টুকটাক এক্সারসাইজ করা শুরু করুন। এক্সারসাইজ করা সবার জন্য জরুরি।  এক্সারসাইজ যে শুধু শরীর ভাল রাখে এমন টা না। আপনার স্ট্রেস, এনজাইটি কমাতে অনেক বেশি হেল্প করবে এক্সারসাইজ। যতই ব্যাস্ত থাকুন না কেন দিনে অন্তত ১০/১৫ মিনিট নিজের এক্সারসাইজ এর জন্য বরাদ্দ রেখে দিন। 

৪) আপনার খাবারের প্লেট থেকে সব ধরনের আনহেলদি ফুডকে টাটা বাই বাই করে দিন। চিনি,সয়াবিন তেল থেকে শুরু করে ভাজাপোড়া, ফাস্টফুড, সকল জাংক ফুড। নিজের জন্য নিউট্রিশিয়াস মিল তৈরি করুন। দেখবেন ১৫ দিনের মধ্যে আপনি পরিবর্তন টা বুঝতে পারছেন। 

ফর্সা হওয়ার অনেক উপায়। তার মধ্যে একটি হলো টমেটো

৫) বেশি বেশি পানি পান করুন। দিনে অন্তত ২.৫ থেকে ৩ লিটার। এক কাজ করতে পারেন। একটি ২ লিটার ও ১ লিটারের বোতলে পানি ভরে নিয়ে টার্গেট করবেন আপনাকে ১ দিনে এটা শেষ করতে হবে। এবং ৩/৪ ঘন্টা পরে আপনি দেখবেন আপনার কতটুকু পানি খাওয়া হয়েছে। 

৬) বিয়ের আগে সব থেকে ইমপরটেন্ট জিনিস। নিজের স্লিপ সাইকেল ঠিক করা। মডার্ন যুগে আমাদের সব থেকে কমন সমস্যা আমরা ঘুমাতে যাই রাত ৩ টায় উঠি ৭ টায় এরপরে ৮ টায় গিয়ে সকালে ভার্সিটির ক্লাস বা অফিস ধরি। এই বাজে স্লিপ সাইকেল এর প্রভাব আমাদের শরীরের উপর খুবই বাজে ভাবে পরছে। রাতে অন্তত ১১ টার মধ্যে ঘুমাতে চেষ্টা করা সবার জন্য মাস্ট।

৭) নিজের স্ট্রেস, এনজাইটি লেভেল কমাতে ব্রিদিং প্রাকটিস করতে পারেন। 

৮) যাদের একনি বা ব্রণের সমস্যা আছে। তারা প্রপার স্কিন কেয়ার করবেন। প্রয়োজন হলে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করবেন। 

৯) নিজেকে একটু বেশি সময় দিন। আপনার ভালোলাগা, খারাপ লাগা গুলোকে আরও ভালভাবে বুঝুন। সাথে পরিবারকে বেশি সময় দিন। 

১০) স্ক্রিন টাইম কমিয়ে অর্থাৎ মোবাইলে সময় নষ্ট না করে হেলদি ম্যারেজ রিলেটেড কিছু বই পড়ে ফেলতে পারেন। বা আপনার আশে পাশের সাকসেসফুল কাপলদের থেকে ছোট খাটো ট্রিকস শিখে নিতে পারেন।

১১) যারা একটু ইন্ট্রোভাট আছেন তারা নিজের সোশ্যাল ইন্টারেকশন কিভাবে বাড়াবেন সেই প্রাকটিস করতে পারেন। 

১২) কিছু ব্যাসিক লাইফ স্কিল যেমন টুকটাক কিছু রান্না সাথে অন্যান্য কাজগুলো প্রাকটিস করতে পারেন। 

১৩) কিছু অত্যাবশকীয় সাপ্লিমেন্ট নেয়ার সাজেশন থাকবে বিয়ের আগে- ভিটামিন বি, সি, ডি, ই এবং ওমেগা থ্রি। 

মনে রাখবেন লাইফ কিন্তু সিনেমাতে বা মোবাইলের ভিডিওতে যেমন দেখায় তেমন না। আমরা কেউ পারফেক্ট না।  আমাদের প্রতিনিয়ত নিজেদের সাথে প্রতিযোগিতা করতে হয় নিজেকে ছাড়িয়ে যাবার। তাই নিজের জন্য নিজেকে পরিবর্তন করে জীবনের সব থেকে দীর্ঘ সময়টার জন্য প্রস্তুতি নিন। 

যাদের পিসিওএস বা হরমোনাল ইমব্যালেন্স আছে তারা বিয়ের প্রস্তুতি কিভাবে নিবেন?? 

পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম বা পিসিওএস এখন মেয়েদের মধ্যে সব থেকে কমন সমস্যার একটি। যাদের পিসিওএস বা হরমোনাল ইমব্যালেন্স আছে তাদের বিয়ের সময়ে নিজের যত্ন নিতে একটু বেশিই কেয়ারফুল হওয়া উচিৎ। আগের পোস্টে যে বেইসিক কাজগুলো করার কথা লিখেছিলাম বিয়ের আগে সেই গুলো প্রাকটিস করার পাশাপাশি নিচের পরামর্শ গুলো থাকবে আপনাদের জন্য।

১) যদি আপনার পিসিওএস ধরা পরে থাকে তবে আল্ট্রাসাউন্ড এর পাশাপাশি আরও কিছু হরমোনাল টেস্ট করা আপনার জন্য জরুরি।  

-LH

-FSH

-Progesterone 

-Estrogen 

-Prolactin 

-Testosterone 

-HOMA IR 

আপনার যদি অনিয়মিত পিরিয়ডের সমস্যা থাকে তাহলে এই হরমোন গুলির টেস্ট করে, রিপোর্ট নিয়ে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এবং ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনিষ্ট এর পরামর্শ নেয়া উচিত। 

২) বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পিসিওএস পেশেন্ট দের ওজন বেশি থাকে। যাদের ওজন বেশি তাদের অবশ্যই ওজন কমানোর দিকে নজর দিতে হবে। ওজন কমানোর জন্য ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং শুরু করতে পারেন।  ১৪ ঘন্টা থেকে শুরু করে ১৬,১৮,২০ এভাবে নিজেকে পুশ করুন।

পিরিয়ডের ব্যথা কমানোর ঘরোয়া উপায় ও চিকিৎসা

৩) খাদ্যতালিকা থেকে চিনি এবং রিফাইন্ড কার্ব ( সাদা চাল,আটা,নুডুলস,চাওমিন) এগুলো একদমই বাদ দিন। সেটা আপনার ওজন বেশি থাকুক বা কম। 

৪) অনেকেই লো কার্ব ডায়েট ফলো করতে পারেন না। লো কার্ব ফলো না করলেও আপনার টোটাল কার্বোহাইড্রেট এবং প্রোটিন ইনটেক এর দিকে নজর দিতে হবে। প্রতি কেজি বডি ওয়েটের জন্য ১ গ্রাম করে প্রোটিন নিন। আপনার ওজন যদি ৬০ কেজি হয় তাহলে আপনাকে ডেইলি মিনিমাম  ৬০ গ্রাম প্রোটিন নিতে হবে। এক্ষেত্রে ২০০-২২০ গ্রাম মাংস আপনার প্রয়োজন।  

৫) খাবার তালিকায় ছোলা,বাদাম, বিভিন্ন সিডস,টকদই রাখুন। এতে হেলদি খাবারের অভ্যাস তৈরি হবে + হাবিজাবি খাবার প্রবনতা কমবে। 

৬) পিসিওএস পেশেন্ট দের আরেকটা কমন সমস্যা হলো এক্সেসিভ লোয়ার বেলি ফ্যাট। শরীরে ওজন না থাকলেও দেখা যায় বেলি ফ্যাট কোন ভাবেই কমতে চায়না। এক্ষেত্রে এক্সপার্ট কারো পরামর্শ নিয়ে এক্সারসাইজ শুরু করুন। এবং ডেইলি অন্তত ৪/৫ কি.মি হাটুন। 

৭) ঘুমের সমস্যা নেই এমন আপু খুব কম পাওয়া যাবে। চেষ্টা করবেন রাতে ১১ টার মধ্যে ঘুমিয়ে পরার। ঘুমানোর ২ ঘন্টা আগে ১ কাপ ক্যামোমাইল চা খেতে পারেন। এতে ঘুম ভালো হবে। 

৮) এনজাইটি, মুড সুইং অনেকের ক্ষেত্রেই অনেক প্রকট হয়। এক্ষেত্রে ব্রিদিং এক্সারসাইজ শুরু করতে পারেন। সাথে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় মাচা টি যোগ করতে পারেন। 

৯) কিছু হার্বস এবং মশলা পিসিওএস পেশেন্ট দের জন্য ভালো কাজ করে। যেমন- মেথি, তিসি, কাচা হলুদ গুড়া, দারুচিনি, অশ্বগন্ধা।  এগুলো খাবারের নিয়ম আরেকটি পোস্টে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।  

১০)  সাপ্লিমেন্ট হিসেবে - ভিটামিন সি, ডি, ম্যাগনেসিয়াম, ওমেগা থ্রি এবং ভিটামিন ই সবাই নিতে পারবেন। 

পিসিওএস আসলে একদিন দুইদিনের সমস্যা না। আমাদের দীর্ঘদিন এর অনিয়ন্ত্রিত লাইফস্টাইলের ফসল এই পিসিওএস। যেই সমস্যা টা আমাদের দীর্ঘদিন ধরে বিল্ড আপ করেছে সেটা ১৫ দিন বা ১ মাসে ঠিক হয়ে যাবে এমন ভাবাটা বোকামি।  তবে হ্যা ছোট ছোট চেইঞ্জের মাধ্যমে এই সমস্যা থেকে বের হবার পদক্ষেপ আপনি শুরু করতে পারেন। 

পিসিওএস কিন্তু শুধু একটি সিংগেল সমস্যা না। পুরো হরমোনাল সিস্টেমের উপরেই এর প্রভাব আছে। এবং এক একজন এর সমস্যা এক এক রকম। একটু ঘাটাঘাটি করলেই দেখবেন যে পিসিওএস এর কোন মেডিসিন নেই। লাইফস্টাইল পরিবর্তনই এর একমাত্র সমাধান। যেহেতু পিসিওএস প্রবলেম টা খুবই ইন্ডিভিজুয়ালিস্টিক  তাই পরামর্শ থাকবে যদি আপনার পিসিওএস থাকে তবে অবশ্যই ডাক্তারের পাশাপাশি একজন নিউট্রিশনিষ্ট এর পরামর্শ নিয়ে নিজের বিয়ের প্রস্তুতি শুরু করার। বিয়ের কাপড়,গয়না এবং অন্যান্য প্রস্তুতিতে যেমন কম্প্রোমাইজ করবেন না তাহলে নিজের স্বাস্থ্যের সাথে কেন কম্প্রোমাইজ করবেন বলুন তো!! 

সুমাইয়া শিলা 

নিউট্রিশনিষ্ট 

চাইল্ড এন্ড রিপ্রোডাক্টিভ নিউট্রিশন কনসালট্যান্ট 

বিএস, পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট, 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম