আইবিএস কি? আইবিএস হওয়ার কারণঃ
কোন কিছু খেলেই যদি আপনার হজমে সমস্যা হয়, কন্সটিপেশন বা ডায়রিয়া হয়ে যায়, পেট ফাপা দিয়ে থাকে কিংবা এসিডিটি হয় তাহলে খুব বেশি সম্ভাবনা আছে আপনার আইবিএস নামক রোগটা আছে।
আইবিএস বা ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম বহুল আলোচিত একটি রোগ। এই রোগ আসলে কেন হয় সেটা এখনো গবেষকরা জানতে পারেন নি। তবে গবেষকেরা এই রোগকে নিউরোগ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ডিজঅর্ডার বা গাট/অন্ত্র এবং ব্রেইনের একটি রোগ বলে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এই সমস্যাটি মূলত হয় আমাদের ব্রেইন এবং গাট হেলথের মধ্যে। কিভাবে এরা একে অপরের সাথে সমন্বয় করে চলবে এবং এই সমন্বয়ে কোন ধরনের সমস্যা হলেই মূলত হজমে সমস্যা হয় । এখানেই আসলে আইবিএস এর একট প্রধান কারন লুকিয়ে আছে।
যখন আপনার মস্তিষ্ক এবং অন্ত্রের মধ্যে যোগাযোগের সমস্যা হয়, তখনই প্রথম যে সমস্যা টা দেখা যায় সেটা হলো-
পেটের মধ্যে অস্থিরতা- আপনি যখন কোন খাবার খাবেন তখন আপনার খাবার জিআই ট্রাক্ট (গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ট্রাক্টের) এর মধ্যে থেকে যেতে এবং জিআই ট্রাক্ট এর পেশিগুলো সংকুচিত প্রসারিত হতে সমস্যা ফেইস করে। কোলন (বৃহৎ অন্ত্র) পেশী আইবিএস আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে বেশি সংকুচিত হয়। এই সংকোচনগুলি ক্র্যাম্প এবং ব্যথা সৃষ্টি করে।
ভিসারাল হাইপারসেনসিটিভিটি: আপনার জিআই ট্র্যাক্টে অতিরিক্ত সংবেদনশীল কিছু নার্ভস/স্নায়ু থাকতে পারে। আইবিএস-এ আক্রান্ত ব্যক্তিদের ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা আসলে সাধারন মানুষের তুলনায় কম থাকে। তাই আপনার ডাইজেস্টিভ ট্রাক্ট পেটে ব্যথা বা অস্বস্তির প্রতি বেশিই সেনসিটিভ থাকে।
আইবিএসের আরও কিছু কারন রয়েছেঃ
১)গাট/ অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া: গবেষণায় দেখা গেছে যে আইবিএস আক্রান্ত ব্যক্তিদের জিআই ট্র্যাক্টে ব্যাকটেরিয়ার পরিবর্তন হয়, যা আইবিএস এর লক্ষণগুলি আরও বাড়াতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে সাধারন মানুষের গাটে যে ধরনের ব্যাকটেরিয়া থাকে এদের ব্ ধরন এবং পরিমাণ আইবিএস-এ আক্রান্ত ব্যক্তিদের গাটে থাকা ব্যাকটেরিয়ার তুলনায় ভিন্ন।
২) গুরুতর সংক্রমণ/ইনফেকশন: অনেক মানুষ আছেন যাদের জিআই ট্র্যাক্টে ইনফেকশন হওয়ার ফলে তাদের হজম ক্ষমতা কমে যায় এবং তাদের আইবিএস হয়। এক্ষেত্রে কিছু ব্যাকটেরিয়া উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে।
৩)খাবারে সমস্যা: নির্দিষ্ট খাবারের প্রতি সংবেদনশীলতা বা অ্যালার্জি আইবিএস ট্রিগার করতে পারে।
৪)শৈশবের স্ট্রেস: আপনি জেনে অবাক হবেন স্ট্রেস আইবিএস ট্রিগার করার একটা মেইন ফ্যাক্টর। অনেকেই আছেন যাদের উপরের কোন সমস্যা না থাকলেও শুধু মাত্র স্ট্রেসের জন্য তাদের আইবিএস ট্রিগার করে। এবং যেসব বাচ্চারা শৈশবে শারীরিক, যৌন এবং মানসিক নির্যাতন সহ গুরুতর চাপের সম্মুখীন হন তাদের আইবিএস হবার হার এবং ট্রিগার করার হার অনেক বেশি।
ফিলমেট সিরাপ খাওয়ার নিয়ম এবং এর উপকারিতা
আইবিএস রোগে অনেকে ভুগলেও অনেকেই আমরা আইডেন্টিফাই করতে পারি না আমাদের আদৌ আইবিএস আছে কিনা, আইবিএস থেকে কীভাবে মুক্তি পাবো বা আদৌ কি আইবিএস ভালো হয় কিনা। বিশেষ করে আইবিএস রোগীর ডায়েট কেমন হবে।
আইবিএস সাধারণত ৩ ধরনের হয়ে থাকেঃ
১) আইবিএস সি- এই ধরনের আইবিএস পেশেন্টদের কন্সটিপেশন হয় বা বাথরুম ক্লিয়ার হয়না। কিছু খাবার পরে পেট ফেপে থাকে কিংবা প্রচুর গ্যাস থাকে পেটে।
২) আইবিএস ডি- এই পেশেন্ট দের সাধারণত পাতলা পায়খানা বা ডায়রিয়া হয়ে থাকে এবং সাথে আইবিএস সি এর মত সব ধরনের উপসর্গ থাকে।
৩) আইবিএস বোথ সি এবং ডি- এই ধরনের আইবিএস পেশেন্ট রা ২ ধরনের উপসর্গই ফেইস করেন। কখনো কখনো কন্সটিপেশন আবার কখনো ডায়রিয়া।
আইবিএস থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায়ঃ
আইবিএস এমন একটি রোগ যার কোন মেডিকেল কিওর নেই অর্থাৎ এমন কোন ওষুধ নেই যেটা খেলে আপনার আইবিএস ভালো হয়ে যাবে। যে কোন ধরনের আইবিএস এর জন্য লাইফস্টাইল মোডিফিকেশন একমাত্র সমাধান। এবং একটা বিষয় মনে রাখা জরুরি আইবিএস কখনোই ভালো হয়না। লাইফস্টাইল মোডিফিকেশন এর মাধ্যমে দীর্ঘদিন সুস্থ থাকা পসিবল।
আইবিএস পেশেন্ট দের জেনেরিক ডায়েট সাজেশন দেয়া আসলে খুবই কঠিন। কারন কার কোন খাবারে আইবিএস সিম্পটমস গুলি ট্রিগার করবে এটা বলা যায়না। তবুও কিছু সাধারন পরামর্শ এই উপসর্গ গুলি কমাতে সাহায্য করবে-
১) একটি ভালো মানের প্রোবায়োটিক সাপ্লিমেন্টস। একটি ভালো প্রোবায়োটিক আপনার গাট হেলথকে ভালো রাখতে সাহায্য করবে। আপনার যে টাইপেরই আইবিএস হোক না কেন প্রোবায়োটিক সাপ্লিমেন্টস সবার জন্যই উপকারী। তবে যদি প্রোবায়োটিক ক্যাপসুল আপনার জন্য দামী হয় সেক্ষেত্রে আপনি প্রোবায়োটিক হিসেবে পান্তা ভাত বা দই খেতে পারেন। তবে অবশ্যই টকদই হতে হবে।
২) যাদের আইবিএস টাইপ সি তারা খাবারে বেশি ফাইবার যোগ করুন। তবে এক্ষেত্রে একট বিষয় জেনে রাখা জরুরি ফাইবার সাধারণত ২ ধরনের হয়ে থাকে -
১) এক ধরনের ফাইবার পানিতে দ্রবীভূত হয়- যেমন- ওটস,আপেল,যবের ছাতু,বিভিন্ন টকজাতীয় ফলে থাকা ফাইবার।
২) আরেকটি পানিতে দ্রবীভূত হয় না বা আমাদের শরীরের এনজাইম এদেরকে পুরোপুরি ভেঙে ফেলতে পারে না- যেমন - গম, চাল বা শাক।
ফাইবার চুজ করার ক্ষেত্রে অবশ্যই যে খাবারে দ্রবীভূত ফাইবারের পরিমান বেশি তাকে প্রাধান্য দিতে হবে। বিশেষ করে আইবিএস টাইপ সি রোগীদের ক্ষেত্রে।
আবার অনেক সময় শাক খেলে আইবিএস পেশেন্ট রা হজম করতে পারেন না। কারন শাকে ইনসলিউবল ফাইবার থাকে যা আইবিএস টাইপ ডি পেশেন্ট দের ডায়রিয়া সৃষ্টি করে।
৩) আইবিএস সি যাদের থাকে তাদের ম্যাক্সিমাম কেই দেখা যায় তারা ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স। অর্থাৎ এই পেশেন্ট রা গরুর দুধ খেতে পারেন না। সেক্ষেত্রে আপনি গরুর দুধের পরিবর্তে সয় মিল্ক,আল্মন্ড মিল্ক,ক্যাশিউ মিল্ক নিতে পারবেন।
৪) গ্লুটেন নামটা আমরা অনেকেই শুনে থাকি তবে এটা কি অনেকেই জানি না। গ্লুটেন হলো এক ধরনের প্রোটিন যেটা গম বা এই ধরনের খাদ্যশস্যের মধ্যে পাওয়া যায়।অনেক মানুষের দেখবেন রুটি খেলে সমস্যা হয়। কন্সটিপেশন হয়,এসিডিটি হয়। গমের মধ্যে থাকা গ্লুটেন এই সমস্যার জন্য দায়ী। কিছু কিছু গবেষণাতে দেখা গেছে এই গ্লুটেন ফ্রি ডায়েট আইবিএস পেশেন্ট দের ক্ষেত্রে খুবই উপকারী। সেক্ষেত্রে গমের বদলে ওটস, বাকহুইট নুডুলস,কিনোয়া গ্লুটেন ফ্রি রাইস ভালো অপশন হতে পারে৷
জেনে নিন কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার সিরাপের নাম
৫) আইবিএস সি পেশেন্ট দের জন্য ইসবগুলের ভুসি এবং সোনাপাতা নামে একটি হার্বস এর গুড়া খুবই উপকারী।
৬) সকল ধরনের প্রসেস ফুড বাদ দেয়া। কারন এতে প্রচুর পরিমানে এক্সট্রা স্যুগার, লবণ, ফ্যাট এবং সংরক্ষণের জন্য কেমিক্যাল মিশিয়ে দেয়া হয়৷ তাই আইবিএস পেশেন্ট দের জন্য এটা খুবই ক্ষতিকর। এমনি কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যারা দীর্ঘদিন প্রসেসড ফুড খান তাদের হজম শক্তি কমে যায় এবং আইবিএস হবার একটি আশঙ্কা থাকে।
৭) সকল ধরনের চা কফি থেকে দূরে থাকা। বিশেষ করে যাদের আইবিএস টাইপ ডি বিদ্যমান।
৮) আইবিএস পেশেন্ট দের জন্য আরেকটি ভয়ংকর খাবারের নাম চিনি। আমরা যখন অতিরিক্ত চিনি খাই তখন আমাদের শরীর এই অতিরিক্ত চিনিকে ব্যবহার করে না। ফলে চিনি আমাদের বাওয়েলে চলে যায় এবং ফার্মেন্টেড হয়৷ এই ফার্মেন্টেড স্যুগার/চিনি আমাদের লার্জ ইনটেসটাইন/বৃহদান্ত্রের মধ্যে দিয়ে যায় এবং বাজে ব্যাকটেরিয়া এবং ইস্টের খাবার হিসেবে কাজ করে। এই ব্যাকটেরিয়া বা ইস্ট আমাদের পেটে ব্যাথা তৈরি করে এবং প্রচুর এসিডিটির তৈরি হয়।
৯)আমরা অনেকেই আছি যারা চিনি খাই না। কিন্তু চিনির বদলে চিনির একটি সাবস্টিটিউট খাই যার নাম এসপারটেম/ সুক্রালোজ। আমাদের শরীরের এই ধরনের স্যুগারকে এবসর্ব করতে সমস্যা হয় বিশেষ করে যাদের আইবিএস আছে। এমনকি এই ধরনের স্যুগার সাবস্টিটিউট গুলি আমাদের গাট/অন্ত্রের ভালো ব্যাকটেরিয়া গুলির উপরে খারাপ প্রভাব ফেলে এবং বডির ইনফ্লামেশন বাড়িয়ে দেয়। যার ফলশ্রুতিতে আইবিএস ট্রিগার করে।
তাই চিনি বা আর্টিফিশিয়াল সুইটনারের একটা ভালো অলটারনেটিভ হতে পারে স্টেভিয়া।
১০) কাঁচা রসুন এবং পেয়াজ আইবিএস ট্রিগার করতে পারে। এই দুই মশলা তে ফ্রুকট্যান্স নামে এক ধরনের উপাদান থাকে যেটা ভাঙতে আমাদের শরীরের অনেক কষ্ট হয় বিশেষ করে আইবিএস পেশেন্টদের। তখন এরা গ্যাস সৃষ্টির পাশাপাশি পেটে ব্যাথা এবং ব্লটিং করতে পারে।
১১) অনেক আইবিএস পেশেন্ট দের শাক খেতে অসুবিধা হয়। সেক্ষেত্রে শাকের বদলে বিভিন্ন সবজি খেতে পারেন।
১২) আইবিএস পেশেন্ট দের ক্ষেত্রে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি ফ্যাক্টর। বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে স্ট্রেস যে কোন ধরনের আইবিএস ট্রিগার করে। স্ট্রেস ম্যানেজের জন্য চাইলে ব্রিদিং এক্সারসাইজ করতে পারেন বা মাচা টি স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট এ খুব ভালো কাজ করে।
আইবিএস পেশেন্টদের সাধারণত খাবার দাবারে প্রচুর ঘাটতি হয় যার ফলশ্রুতিতে শরীরে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন এবং মিনারেলস ঘাটতি হয়ে যায়। বিশেষ করে ভিটামিন বি,ভিটামিন ডি, আয়রন এবং ক্যালসিয়াম। আইবিএস পেশেন্ট দের এই ৪ ধরনের সাপ্লিমেন্ট নেয়া উচিত তবে অবশ্যই একজন ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনিষ্ট এর পরামর্শ নেয়ার পরে।
আসলে আইবিএস এর জেনেরিক গাইডলাইন দেয়া অনেক কঠিন। কারন একই ধরনের উপসর্গ নিয়েও দুইজন আইবিএস পেশেন্ট এর দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন খাবারে সমস্যা হয়।যাদের আইবিএস আছে তারা জানেন এটা কখন কোন ভাবে, কোন খাবারে ট্রীগার করবে এটা বলা অনেক কঠিন।
আইবিএস মূলত একটি লাইফস্টাইল বেইজড অসুখ। অর্থাৎ আপনি ডিসিপ্লিনড ওয়েতে লাইফ লিড করলে সারা জীবন ভালো থাকতে পারবেন। এবং আপানার খাবার তালিকা কি হবে, সাপ্লিমেন্ট কি কি হবে, ডোজিং কত হবে এগুলো অনেক গুলো ফ্যাক্টরের উপর ডিপেন্ড করে। তাই আইবিএস পেশেন্ট দের একজন ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনিষ্ট এর পরামর্শ নেয়া অনেক জরুরি।
সুমাইয়া শিলা
নিউট্রিশনিষ্ট,
বিএস,নিউট্রিশন এন্ড ফুড সাইন্স,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।